Monday, 24 November 2025

পার্ট-১

 মাঝ বর্ষার ঘুঁটঘুঁটে রাত। বিলে নেমে যাওয়ার মাটির রাস্তাটায় জেলেদের আনাগোনা বেশ বোঝা যাচ্ছে, সাথে পরিচিত কিছু কণ্ঠস্বর। হারান চাচা, শফিক, হাবু ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা সবাই মাছ ধরবে সারারাত। সকালে মাছগুলো যাবে গঞ্জের হাটে। নৌকাভিত্তিক জেলেদের দল আলাদা আলাদা হয়ে বেড়াজালে মাছ ধরবে। 

মাছ ধরা এদের কারোরই স্থায়ী পেশা নয়। বর্ষায় উজানের ঢলে আত্রাই ফুঁসে উঠলে ডুবে যায় যশের বিল। তখনই আয়ের বিকল্প উৎস হিসেবে এরা কেউ মাঝি, কেউ জেলে হয় নেমে পড়ে শতাব্দী প্রাচীন এই প্রান্তরে।

বিলের পানি অন্ধকারে এখন কুচকুচে কালো। দূরে কখনো ছোট ছোট ডিঙির ছইয়ে টিমটিমে হারিকেনের আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। পুব দিকের নৌকোটায় গান শোনা যাচ্ছে -


           কোন মেস্তরি নাও বানাইলো কেমন দেখা যায়

           ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।।


মনে হয়, জালে মাছ বেশি পড়েছে।

এখানে জীবন খানিকটা প্রাচীন-প্রাগৈতিহাসিক। 

বিলপাড়ের এ জনপদ ঘুমিয়ে গেছে অনেক আগেই। মাটির বাড়িগুলো স্থির পাহাড়ের মতো গিলছে অন্ধকার। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানবশিশুটি হয়তো দাদীর পাশে রূপকথার কেচ্ছা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রূপকথাই বা শুনতে হবে কেন? এ অঞ্চল যে বিস্তৃত লোকগাথাতেও সমৃদ্ধ।

প্রাচীন লোকগাথা অনুযায়ী, বর্ষায় যখন ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়ে তখন মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে একটা নৌকা যেখানে দেখা যায় সোনার পুতুল। বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকেই নাকি দেখেছেন এ দৃশ্য। হঠাৎই আবার উধাও হয়ে যায় সে দৃশ্য। কখনো জালে মাছ পড়ার খলখল শব্দ ওঠে কিন্তু জাল তুললে দেখা যায় সেখানে অস্তিত্ব নেই কোনো মাছের।

রাত জাগা এ জেলেদের সবারই নিজস্ব দুঃখ আছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে হাঁড়কাঁপানো জ্বর বয়ে নিয়ে এসেছে শফিক মিঞা। এ দিয়েই পেটেভাতে কোনোরকমে বেঁচে থাকে তার পরিবার। বাড়িতে বৃদ্ধ মা, দুটো সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে এক ছোট্ট সংসার তার। 

নৌকায় আওয়াজ শোনা যায়- বেডা মাইনষ্যের আবার জ্বর-জার কি? খোদায় তাগদ দিছে তো খাটানের লাইগাই।

কথা থামে, জাল নামানোর শব্দ হয়।

ফজরের আজান পর্যন্ত চলে মাছ ধরার এ মহাযজ্ঞ। আজান পড়লেই নৌকাগুলো ভীড়তে শুরু করবে ঘাটে। কাঁধে করে ছোট্ট পাড়াটার মাঝ দিয়ে পাকা সড়কে ভ্যানগাড়িতে মাছগুলো চলে যাবে আড়তে। 

ভোরের আলোকচ্ছটা কাঠের তৈরি মুরগীর খোপগুলোতে লাগতেই গলা ছেড়ে প্রভাতের জানান দিতে শুরু করে গেরস্থের মোরগগুলো। দূর থেকে বৃদ্ধ মুয়াজ্জিনের ভাঙা গলায় আজানের সুর ভেসে আসে। অন্যসব নৌকার মতো শফিক মিঞাদের নৌকাও ঘাটে ভীড়ে। বাঁশের বড় বড় ঝুড়িতে একে একে মাছ নিয়ে পাড়ার মাঝ দিয়ে পাকা সড়কের দিকে এগোতে থাকে জেলেরা। জেলেদের নিজেদের জন্য সামান্য মাছ রেখে বাকীগুলো ভ্যানে চেপে রওনা হয় আড়তে। অসুস্থ শফিক মিঞা বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। 

মসজিদ থেকে মুসল্লীদের দল নামাজ শেষ করে বের হতে থাকে। তাদের মৃদুমন্দ কথোপকথনে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করে এ জনপদের। মক্তবের দিকে যেতে দেখা যায় শিশুদের কয়েকজনকে।

শফিক মিঞা বাড়ি আসে। বউকে তার ভাগের মাছটুকু দিয়ে সে পাশের পুকুরে নাইতে যায়। জ্বরের শরীলে তার কাঁপুনি দিয়ে ওঠে বার বার। উনুনের ছাইয়ে মাছগুলো কেটে-ধুয়ে হাঁড়িতে আমসত্ত্ব দিয়ে পুঁটি মাছের ট্যালট্যালে ঝোল চাপায় শফিক মিঞার বউ। দুচুলো মাটির উনুনের আরেকটায় মাটির হাঁড়িতে চাপে ভাত। লাকড়ির গনগনে আগুনে দূর থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায় তাদের তালপাতার ঘেরা ছোট্ট হেঁসেলটায়। এই সক্কাল ভোরের রান্নার আয়োজন চলে শুধু এই দরিদ্র জেলে পরিবারগুলোতেই।

শফিক পুকুর থেকে নেয়ে এসে হাঁক ছাড়ে, কইরে হানিফের মা ভাত দে। হানিফ শফিকের বড় ছেলে। তার আর এৃক মেয়ে নাদিরা। একে একে হানিফের মা ভাত, পুঁটি মাছের ছালন হাজির করতে থাকে। শফিক খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বারান্দায় বসে। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে পুঁটি মাছের ছালন শফিক নিঃশব্দে খেতে থাকে। মাঝে মাঝে শুধু খাওয়ার শব্দই কানে আসে। বারান্দার এক কোণে শফিকের মা বসে পান চিবোয়। ততোক্ষণে পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়েছে।


চলবে....




No comments:

Post a Comment